নিউজিলান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে ৫০ জন অভিবাসিত মুসলিম সন্ত্রাসী হামলায় নিহিত ও ৫০ জনের মত আহত হওয়ার ঘটনা বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় তুলেছে। নিহতদের মধ্যে যুদ্ধ বিধ্স্ত সিরিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য নিউজিলান্ডে আশ্রয় নেয়া মানুষদের শেষ রক্ষা হয়নি। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী সহিংস বর্ণবাদের উত্থানের সর্বশেষ ভয়াবহ সাক্ষ্য। নিউজিল্যান্ডের মুসলিম সম্প্রদায় মোট জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ।এশিয়া ও আফ্রিকার অভিবাসীর সংখ্যা তেমন বেশি নয় । তবুও বর্ণবাদীরা অভিবাসীদের সভ্যতার হুমকি হিসাবে উপস্থাপন করে এবং অভিবাসীদের হাতে চাকুরী , ব্যবসা , সংস্কৃতি হারানোর ভয়ের কথা প্রচার চালাচ্ছে। এই ধরনের নির্মম ঘটনা গুলো প্রায়শই ছোট ডান চরমপন্থী দল বা নেটওয়ার্কে, কখনো কখনো বা প্যাথোলজিক্যাল " নিভৃত চারি " দক্ষিণ পন্থীদের কাজ। তবে ঘৃণা বিস্তারের পিছনে ইউরোপ - আমেরিকায় অনেক বড় বড় রাজনৈতিক শক্তি সক্রিয়। জার্মানিতে Pegida, ব্রিটেনে FLA এর Tommy Robinson, UKIP এর Gerald Batten, ফ্রান্সে National Front, অস্ট্রেলিয়াতে Pauline Hanson আর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এদের অন্যতম।
এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিন্দা, প্রতিবাদে ঝড় উঠে , সাথে সাথে শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক ভণ্ডামি শুরু হয়। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিনডা আর্ডেন ঘোষণা করেন " নিউজিল্যান্ডে ঘৃণার কোন জায়গা নেই"। অথচ জেসিনডা আর্ডেন এর নেতৃত্বাধীন নিউজিল্যান্ড লেবার পার্টি নিউজিল্যান্ড ফার্স্ট পার্টির সাথে সরকার গঠন করে ২০১৭ সালে। নিউজিল্যান্ড ফার্স্ট পার্টি প্রকাশ্যেই ফ্যাসিবাদী দল। জেসিনডা আর্ডেন মন্ত্রী সভায় নিউজিল্যান্ড ফার্স্ট পার্টির সদস্য রয়েছে। প্রসঙ্গত ২০১৭ সনের দেশটির জাতীয় সংসদ নিউজিল্যান্ড ফার্স্ট পার্টি প্রাপ্ত ভোটের মাত্র ৭.২ শতাংশ ভোট পেয়েছিলো। ইতিমধ্যে জেসিনডা আর্ডেন সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে অনেক কোথায় বলেছেন, মুসলিম অভিবাসিতদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডের আগ্নেয় অস্রের লাইসেন্সে আইন পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন। জেসিনডা আর্ডেন এর এসব কর্মকান্ড প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু ঘরের মধ্যে - সরকারে অভিবাসন বিরোধী নিউজিল্যান্ড ফার্স্ট পার্টিকে সাথে নিয়ে সমাজের মধ্যে যে বর্ণবাদী চিন্তা চেতনা রয়েছে তাকে কি ভাবে মোকাবেলা করবে তা স্পষ্ট নয়।
মসজিদে হামলাকারী ব্রেন্টন টারান্ট,২৮ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক, বর্ণবাদী ও শেতাঙ্গদের প্রাধান্য ও শ্রেষ্টত্ব -এ বিশ্বাসী । অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে অভিভাসন সম্পর্কিত চুক্তি থাকার কারণে উভয় দেশের নাগরিকেরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়াই অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ডের সমান নাগরিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে বসবাস করতে পারে। ব্রেন্টন টারান্ট অভিভাসন আইনের শিথিলতাকে কাজে লাগিয়ে নিউজিল্যান্ডে আস্তানা পেতে বসে। হামলাকারী ব্রেন্টন হামলার সময় হেলমেট ক্যামেরা থেকে আক্রমনের সরাসরি সম্প্রচার করে। এই ভিডিও ক্লিপগুলি ফেইসবুক , টুইটার, ইউটিউব এবং অন্যান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধমের প্রচার বর্ণবাদী মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। ব্রেন্টন টারান্ট গণহত্যা উদ্দীপনা ও বর্ণবাদ প্রচারের জন্য জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে কার্যকরী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে।
এই হামলার দুই দিন আগে, হামলাকারী ব্রেন্টন টারান্ট নরওয়ের নব্য-নাৎসি, গণ হত্যাকারী, Anders Breivik এর অনুসরণ করে ৭৪ পাতার ঘোষণা পত্র "The Great Replacement" প্রকাশ করে। এই ঘোষণাপত্রে মুসলিম অভিবাসন ও সন্ত্রাসবাদকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে "নতুন সাদা" যুগ স্থাপনকারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ব্রেন্টন টারান্ট নরওয়ের নব্য-নাৎসি, গণ হত্যাকারী, Anders Breiviকে আদর্শ ও অনুপ্রেনা হিসেবে বর্ণনা করেছে। ২০১১ সনে Anders Breivi গুলি করে ৭৭ জন ছাত্র যুবককে নির্মম ভাবে হত্যা করে। ব্রেভিক নারীবাদী ও কালো ও এশিয়ান, মুসলিম, ইহুদি, সমকামী বিরোধী। নিউজিল্যান্ডে হামলাকারী ব্রেন্টন টারান্ট সহ এই ঘরনার অনেকের কাছে Anders Breivi ঘৃণা সৃষ্টির ‘আদর্শ ' মানুষ হিসেবে পরিচিত।
Anders Breivi কোন উপাসনালয়ে হামলা চালায়নি। তার হামলার লক্ষ্য Workers' Youth League (AUF), সম- সমাজ পন্থী রাজনৈতিক সংগঠন। Anders Breivi লক্ষ্য বস্তু Workers' Youth League (AUF) কারণ এই সংগঠনটি শরণার্থীদের সমর্থন ও সাহায্য করে আসছিলো । Anders Breivi হত্যার শিকারদেরকে “race traitors" হিসেবে বর্ণনা করেছে। Anders Breivi হত্যাকাণ্ডের উদাহরণটি পরবর্তী বছরগুলিতে বর্ণবাদী কর্মকান্ডকে উৎসাহ জুগিয়ে আসছে। Breivik এর জঘন্যতম গণহত্যা একাকীই সংগঠিত করে ছিল , তার কোন সহযোগী ছিল না বলেই নরওয়ের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মনে করে।
Breivik মত লোকেরা কল্প কাহিনী ( মিথ) , মিথ্যা - ষড়যন্ত্রকে রঙ লাগিয়ে প্রচার করতে সিদ্ধহস্ত। এরা নিজেদের মত - পথ প্রচারের জন্য বন্দুক ও সামাজিক গণ মাধ্যমকে ব্যবহার করে সচরাচর গোপন নেটওয়ার্ক , সম্প্রদায় গড়ে তোলে। টারান্ট এর ম্যানিফেস্টো ব্রিভিকের ম্যানিফেস্টো এর অনুরূপ, দুটোতেই নতুন কিছু নেই বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার কৃত পুরানো , প্রচলিত বর্ণবাদী ধারণা গুলোকে একসাথে গ্রন্থিত করা।
অনেকদিন ধরেই উপাসনালয় আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু। তবে শুধু মাত্র মুসলমানদের উপাসনালয় আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কালো মানুষদের গীর্জা বিভিন্ন সময়ে আক্রমণের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ২০১৫ সালের ১৭ জুন আমেরিকার দক্ষিণ ক্যারোলিনা শহরের চার্লসটন শহরের আফ্রিকান মেথডিস্ট গীর্জায় বর্ণবাদী হামলায় ৯ জন কালো মানুষকে হত্যা করা হয়। ২০১৭সালের ১১-১২ অগাস্ট , নব্য নাৎসিরা আমেরিকার ভার্জিনিয়া " ইহুদিরা আমাদের প্রতিস্থাপন করবে না" এবং " আমাদের রক্ত আমাদের মাটি " স্লোগান দিয়ে খুনাখুনি চালায়। ২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর, আমেরিকার পেনসিলভানিয়াতে ইহুদী উপাসনালয়ের উপর হামলা ১১ জনকে হত্যা ও সাত জনকে মারাত্মক ভাবে আহত করে নব্য নাৎসিরা। ২০১০ সালের ২৮ মে পাকিস্তানের দুইটি পৃথক হামলায় শিকার হন আহমেদিয়া মুসলিমদের মসজিদ। ৯৪জন নিহত ও ১২০ জনের মত আহত হয় এই হামলা দুইটিতে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে শিয়া মুসলিমরা তাদের মসজিদে বহুবার সহিংস হামলার শিকার হয়ে আসছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই আহমাদিয়া মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। চাকুরী ও সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের পাশাপাশি সহিংসতার শিকার।
বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশে নিউজিল্যান্ডের এই হত্যাকান্ড রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছে। অধিকাংশ মুসলিম প্রধান দেশে গণতান্ত্রিক বাবস্থা , আইনের শাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, যা আছে তা হল নামকায়াস্তে নির্বাচন ।এই সমস্ত দেশের শাসকদের দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিনিতিতে জনসংখার বড় অংশ বেকার, লাখ লাখ লোককে কাজের সন্ধানে দেশান্তরী হতে হয়েছে। মুসলিম দেশ গুলোতে জাতীয় ও ধমীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা শোচনীয়। বিগত ৫০ বছরে সমস্ত মুসলিম প্রধান দেশে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যা লঘুদের সংখ্যা কমেছে। এই সংখ্যা কমে যাবার পিছনে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও নিরাপত্তা হীনতা কাজ করেছে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৩০% এখন এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০% । পাকিস্তানে হিন্দু ও খৃস্টান দের সংখ্যা কমার হার বাংলাদেশের অনুরূপ। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আহমেদি মুসলিমদের উপর নির্যাতন প্রকাশ্যেই হয়ে থাকে। আহমেদি মুসলিমদের পক্ষে কথা বলার মানুষের সংখ্যা কম , আর যারাই কথা বলেন তাদের উপর ধমীয় উগ্রপন্থীদের খড়গ নেমে আসে। ক্ষমতাসীনরা ধর্মীয় উগ্র পন্থাকে কখনো প্রকাশ্যে কখনো নীরবে সমর্থন করে। তুরস্ক , পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইরান এর মতো দেশে দেশে জাতি সুমুহের আত্ম নিয়ন্ত্রণের সংগ্রামকে চরম নিপীড়ন করে দমিয়ে রাখা হচ্ছে।
তুর্কি রাষ্ট্রপতিএরদোগান ক্রাইস্টচার্চ মসজিদ গণহত্যার অস্ট্রেলিয়ান বন্দুকধারীর সাথে এক শতাব্দীরও বেশি আগে অস্ট্রেলিয়ায় এবং নিউজিল্যান্ডের সেনাদের জড়িত যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ান বন্দুকধারীকে সংযুক্ত করে বক্তব্য দিয়েছেন। তুর্কি রাষ্ট্রপতিএরদোগান অন্তত পক্ষে আটটি নিবার্চনী জনসভায় মসজিদের শুটিংয়ের ফুটেজ প্রচার করে ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টি করে ভোটারদের আকৃষ্ট কোনো উদ্যোগী হয়েছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী নিউজিলান্ডের সন্ত্রাসী হামলাকে অমুসলিমদেরকে কোনঠাসা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই সকল হত্যা, অত্যাচার - সেটা মুসলিম ,ইহুদী, অভিবাসী শ্রমিক, কালো কিংবা এশিয়ান, আহমাদিয়া - শিয়া মুসলিম দের বিরুদ্ধে হোক না কেন এই গুলোর মধ্যে একটা যোগ সূত্র রয়েছে। সাধারণ যোগসূত্র হচ্ছে বর্ণবাদ - পরমত অসহিষ্ণুতা। অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা - পুঁজিবাদের সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে , এই সংকট কাল পুঁজিবাদ উত্তরণের জন্য নানা ধরণের পশ্চাদপদ ধারণাকে লালন ও উৎসাহিত করে। সমাজ শ্রেণী বিভক্ত।যখন শ্রেণী বিভিক্ত সমাজের কোন অংশ তীব্র সামাজিক সংকটের মুখোমুখি হয় , কিন্তু এই সামাজিক সংকটের উৎস দেখতে পারে না তারা সহজেই সামাজিক সংকটের জন্য অন্য কোন অংশকে দায়ী ভাবে। সামাজিক সংকটের মুখোমুখি অংশ তাদের বঞ্চনা - বিরক্তির জন্য সমাজের অপেক্ষাকৃত দুর্বল অংশকে দায়ী করে থাকে। এই হচ্ছে বর্ণবাদের দার্শনিক ভিত্তি। বর্ণবাদ - পরমত অসহিষ্ণুতা পুঁজিবাদের অভ্যান্তরীন সংকটের ফল।
বর্ণবাদী চিন্তা, জাতি - সম্প্রদায় গত বিদ্বেষ, ছড়ানোর মূল হোতা হচ্ছে ডানপন্থী পুঁজিবাদী দল, কোটিপতি মিডিয়া, এবং